থামছে না রোহিঙ্গাদের স্রোত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতন এড়াতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্রোত যেন থামছেই না। প্রতিদিন নতুন করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর বহর ‘মৃত্যুপুরী’ রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটছে। মৃত্যুভয়ে ভিটেবাড়ি আর স্বজন হারানোর শোক বুকে নিয়ে পাহাড়িপথে, মিয়ানমার বাহিনীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে ৭ থেকে ১০ দিন হেঁটে সীমান্তে পৌঁছাচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত এসব মানুষ। তাদের মুখে নির্যাতিত হওয়ার করুণ কাহিনী। লোমহর্ষক নির্যাতন পৃথিবীর কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না কোনো সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মীকে। এ অবস্থায় স্যাটেলাইট ইমেজের ভিত্তিতে প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানোর পেছনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জড়িত। চট্টগ্রাম ব্যুরো ও কক্সবাজার সংবাদদাতার পাঠানো খবর

রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিনই একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। শুক্রবার আল জাজিরা টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুত করার ঘটনাকে ‘জাতিগত নিমূল অভিযান’ বলে উল্লেখ করা হয়। এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন একই ধরনের মন্তব্য করেছিল। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন সরকারের আচরণে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা রোহিঙ্গা নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ পরিস্থিতিতে কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছেন সু চি। চলতি মাসে জাতিসংঘের অধিবেশনেও যোগ দিতে পারছেন না তিনি। মিয়ানমারে শান্তি স্থাপনের অঙ্গীকার নিয়ে নোবেল পাওয়া নেত্রী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোয় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

নাফ নদীর এপার থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়তে দেখা যায়। ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দৃশ্য নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই আহত ও রক্তাক্ত। দীর্ঘ পথে অনেকে রেখে এসেছেন বৃদ্ধ মা-বাবাকে। তারা জানেন না, আবার কখনও মা-বাবার মুখ দেখতে পারবেন কিনা। এরকমই একজন শব্বির আহমদ (৪৬)। পরিবারের ১৪ সদস্য নিয়ে তিনি বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করেন। সঙ্গে ছিলেন মা-বাবা, সন্তানসহ কয়েক আত্মীয়। পুুরুষদের কাঁধে মালপত্রের ভার। নারীদের কোমরে শিশুসন্তান। কিশোরদের কাঁধে মাদুর কিংবা ত্রিপল। বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে নিয়ে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে এরাও পথচলা শুরু করেছিল। শব্বির জানান, বর্মী সেনাদের নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও মৃত্যু থেকে প্রাণে বাঁচতে নিজ গ্রাম ছেড়ে কখনও পাহাড়, কখনও ধানের মাঠ, গ্রাম্য পথে তাদের হাঁটতে হয়েছে। ১০ দিন পর নাফ নদীর তীরে বাংলাদেশ ভূখ-ের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে পা রাখেন শব্বির আহমদ ও তার পরিবারের ১৪ সদস্য। তিনি জানান, মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্ত থেকে ২ লাখ ৯০ হাজার কিয়াত (মিয়ানমার মুদ্রা) ও একটি কানের দুল দিয়ে রাতে তাদের নাফ নদী পার হতে হয়েছে। শব্বির আহমদ রাখাইনের রাছিডং থানার লামার পাড়ার বাসিন্দা। তিনি জানান, ২৫ আগস্টের পর বর্মী পুলিশ ও সেনারা চারদিক থেকে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো ঘিরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। লঞ্চার মেরে জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর। মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ওই সময় অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অনেকেই বাড়ির ভেতরে পুড়ে ছাই হয়েছেন। শব্বির বলেন, এতকিছুর পরও নিজের দেশ ও গ্রাম ছেড়ে এ দেশে আসতে চাইনি। কিন্তু আমাদের পাশের সোহাবপাড়া গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা। ওই পাড়ায় ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। তার মধ্যে ৩৪০ জনকে খুঁজে পেয়েছেন তারা। বাকিরা পুড়ে মারা গেছেন।

শব্বির আহমদ বলেন, রাখাইনের রাছিডংয়ের আদ্দুইল্লাপাড়া, চান্দুপাড়া, নিলম্বাপাড়া, উপরপাড়া, আইডি ক্যাম্প গ্রামের অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা একসঙ্গে ঈদের দ্বিতীয় দিন (ঈদুল আজহা) বাংলাদেশের দিকে রওনা দেন। তিনি বলেন, রাত ১২টার সময় আমরা রাখাইনের পূর্বাঞ্চল থেকে বড় পাহাড়ের রাজারবিল ঢালুপথ দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের দিকে এগোতে থাকি। প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর সীতাপুরীক্ষা গ্রামে পৌঁছে আমাদের দল। সেখানে সেনাদের ঘাঁটি থাকায় আবার গয়ামবারি পাহাড়ের ঢালুপথ দিয়ে গেরাংঢং বা করাইতলীতে পৌঁছে চর এলাকায় অভুক্ত রাত কাটাই। পরদিন সকাল হলে ক্লান্ত ও অভুক্ত শরীরে হাঁটতে থাকি গ্রামের পর গ্রাম। তিনি জানান, আসার পথে যত গ্রাম তারা দেখেছেন, সবই যেন মৃত্যুপুরী ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে। মাঠে মাঠে ধানের শীষ বাতাসে নুইয়ে পড়ছে। গরুগুলো তাদের মনিবদের হারিয়ে হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে সেনাদের টহল নজরে পড়লে মনে হয়, মৃত্যুদূত যেন আমাদের কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি বলেন, পথে পথে মৃত্যুভয়, আতঙ্ক, ঝুঁকি আর লাশের গন্ধ। এভাবে প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্ক ও মৃত্যুর ভয় নিয়ে হেঁটে ১০ দিন পর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্তে পৌঁছায়।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শব্বির আহমদ জানান, ওই সীমান্তে তখন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। নাইক্ষ্যংদিয়ায় ছয় দিন অবস্থানের পর ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে শব্বিরের পরিবার। তিনি জানান, ওপারে (মিয়ানমারে) যারা রয়েছেন, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। খাবার নেই, পানি নেই; খাবার কেনার অর্থও নেই তাদের। তারা এপারে আসতে পারছেন না। শুধু শব্বির নন, একই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন মিয়ানমার সীমান্তে আরও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী। নিজ দেশে তাদের পাখির মতো হত্যা করা হচ্ছে; যখন ইচ্ছা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণনায় এসব উঠে আসছে।

৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও কাঁধে অক্ষম মা-বাবা : শব্বির আহমদের পরিবার যখন বাংলাদেশের দিকে রওনা করে, তখন আরেকটি পরিবারের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। মোহাম্মদ নুরুর (৩৫) পরিবারে ছিলেন চলতে অক্ষম বাবা আলী হোসেন (৯৩) ও গর্ভধারিণী মা নূর বিবি (৭৭)। এ দুইজনকে কাঁধে নিয়েই পথ চলছিলেন মোহাম্মদ নুরু; সঙ্গে ছিলেন তার ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও চার শিশু। এ সন্তানদের মধ্যে দুইটি কোলের, অন্য দুই ছেলেমেয়ে কোনো রকম হাঁটতে শিখেছে। শব্বির জানান, নুরু তার মা-বাবাকে কাঁধে নিয়ে দুয়েকটি গ্রাম হাঁটার পর রাতে রাজারবিল পাহাড়ি ঢালুপথে পৌঁছেন। ঢালুপথের মাঝখানে ভার নিতে পারছিলেন না ক্লান্ত নুরু। দলের অন্যরাও তার জন্য অপেক্ষা করছেন না। এ অবস্থায় পাহাড়িপথে নুরু একা হয়ে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে ওই পাহাড়ি ঢালুতেই ত্রিপলের ছাউনি, কিছু খাদ্য ও দেড় লাখ কিয়াত মা-বাবার হাতে দিয়ে তাদের রেখেই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হন তিনি। শব্বির জানান, শুধু নুরুর মা-বাবা নন, একই এলাকার মৃত কালুর স্ত্রী, কাছিম আলীর ছেলে বাটুসহ বিভিন্ন এলাকার আরও ৬ থেকে ৭ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখতে পান। হৃদয়বিদারক এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। কে জানে পাহাড়ের ঢাল থেকে এ বৃদ্ধদের কেউ কখনও উদ্ধার করবে কিনা, নাকি দুর্গম পাহাড়েই স্বজনহীন অসহায়ত্বে জীবনের ইতি টানবেন তারা।

মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ তরুণী চমেকে : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মিয়ানমারে সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা গুলিবিদ্ধ খালেদা নামে এক তরুণী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুক্রবার ভোর রাতে স্বজনদের মাধ্যমে তাকে হাসপাতালে আনা হয়। খালেদা আকিয়াব জেলার মংডু এলাকার নুরুচ্ছালামের মেয়ে। চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ খালেদাকে প্রথমে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর